প্রবাসী আয় বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে করণীয়

Loading...

প্রবাসী আয় বৃদ্ধি অব্যাহত রাখতে করণীয়

বিশ্বায়নের যুগে প্রতিটি বিকাশমান অর্থনীতির জন্য গ্রোথ ক্যাপিটাল বা উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এটি আসে রপ্তানি আয় কিংবা বিদেশি বিনিয়োগ থেকে। কিছু দেশে আসে প্রবাসী আয় কিংবা বিদেশি অনুদান থেকে।

কাতারে বিভিন্ন কোম্পানিতে নতুন চাকরির খবর

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বড় উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। তবে রপ্তানির সঙ্গে যেহেতু সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির ব্যয় নিষ্পন্নের বিষয় যুক্ত; বিদেশি উৎস থেকে নিট আয় বিবেচনায় প্রবাসী আয়ই অনেক প্রভাবশালী।

Loading...

এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিরাট জনগোষ্ঠীর বিদেশে কর্মসংস্থানের বিষয়ও জড়িত। প্রবাসী আয়ের বড় অংশ যেহেতু গ্রামে আসে; গ্রামীণ জনগণের অর্থনৈতিক রূপান্তরেও এটি বিরাট ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটসহ নানামুখী চ্যালেঞ্জে থাকা অর্থনীতিতে এটি স্বস্তির সঙ্গে অনেক আশারও সঞ্চার করে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে ২ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে দেশে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮ বিলিয়ন ডলার।

প্রবাসী আয়ের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ধরে রাখা গেলে তা অনেক সংকট সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে। আমরা জানি, দেশের রিজার্ভ অনেক দিন ধরে নিচুতে। পর্যাপ্ত রিজার্ভ ছাড়া জ্বালানি তেল, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধের মতো জরুরি পণ্য আমদানি করা যায় না।

কাতারের সব আপডেট হোয়াটসঅ্যাপে পেতে এখানে ক্লিক করুন

এমনকি বিদেশি ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় রিজার্ভ থেকে। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ ২১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। সেখানে প্রণিধানযোগ্য অবদান রেখেছে প্রবাসী আয়।

Loading...

রিজার্ভের পাশাপাশি ডলার তারল্য জোগানেও প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম। আগেই বলেছি, এ আয় ডলার জোগানের দায়বিহীন উৎস। এর বিপরীতে কোনো বিদেশি মুদ্রার দায় পরিশোধ করতে হয় না। তাই রেমিট্যান্স বাড়লে ডলারের স্থিতি তুলনামূলক বেশি বাড়ে।

দুটি ধর্তব্য সংকট মোকাবিলায় ডলারের জোগান আরও বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এক. বিদেশি ঋণ পরিশোধ এবং দুই. আমদানি দায় মেটানো। তা ছাড়া সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি ও ঋণ পরিশোধের যে তথ্য তুলে ধরেছে, তা বেশ উদ্বেগজনক।

Loading...

সেদিকে লক্ষ্য করলে নিকট ভবিষ্যতে প্রবাসী আয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায়।
ইআরডির তথ্য বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি কমেছে ৯১ শতাংশ।

আবার এ সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৭ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ১৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২২ শতাংশের বেশি।

Loading...

আশঙ্কা রয়েছে, কিছু প্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। সেই সঙ্গে থাকবে বাড়তি সুদের বোঝা। এতে স্বাভাবিকভাবেই রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়বে। ডলার সংকটের কারণে আমদানি দায় ও বৈদেশিক ঋণও বেড়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে প্রবাসী আয় না বাড়লে সংকট আরও তীব্র হয়। নিম্নমুখী ধারায় প্রবাসী আয়, ডলার ও রিজার্ভ সংকট, বিদেশি ঋণ ও আমদানি দায় পরিশোধ– একটি আরেকটিকে চক্রাকারে প্রভাবিত করে।

একটি সূচকে অবনতি দেখা দিলে অন্য সূচকগুলোও নড়বড়ে হয়ে ওঠে। তখন এসব ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ও পরিস্থিতির উন্নয়নে অন্যতম সহযোগী হতে পারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবাসী আয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের কথাও প্রাসঙ্গিক।

Loading...

তবে রপ্তানি আয়ের বিপরীতে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও রপ্তানি পণ্য তৈরির কাঁচামাল আমদানিসহ আরও অনেক কাজে ডলার ব্যয় হয় বেশি। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট মোচনে রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এ ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে, সে জন্য বিশেষ মনোযোগ ও দৃশ্যমান উদ্যোগ প্রয়োজন। উন্নয়ন সহযোগীরা এমনকি শ্রমিক আমদানির দেশগুলোও এ ক্ষেত্রে বিরাট সহায়তা করতে পারে।

আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি প্রবাসীদের প্রতিশ্রুতি বা আস্থা বৃদ্ধি। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সংঘাত-সংঘর্ষ, সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় বাংলাদেশি প্রবাসীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে রেমিট্যান্স শাটডাউনের আহ্বান জানায়।

Loading...

পরবর্তী সময়ে সরকারের পতন হলে তারা নতুন সরকারকে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে সহযোগিতার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। সেই সঙ্গে হুন্ডির প্রয়োজনীয়তাও কিছুটা কমেছে।

আগে কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক অনেকটা প্রকাশ্যে হুন্ডিকে উৎসাহিত করেছে। সংগৃহীত বৈদেশিক মুদ্রা আন্ডার-ইনভয়েসিংয়ে কাজে লাগানো হয়েছে।

দেশে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির অন্যতম অন্তরায় হুন্ডি। ব্যাংক খাত-সংশ্লিষ্টদের মতে, হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় অঙ্কই হাতছাড়া হয়ে যায়, যার বার্ষিক মোট পরিমাণ ২০-২৫ বিলিয়ন ডলার।

Loading...

আবার প্রবাসে কর্মী পাঠাতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো গত ১০ বছরে কর্ম ভিসার জন্য হুন্ডির মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার বা সমপরিমাণ টাকা লেনদেন করেছে। এগুলো বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় প্রাপ্তির বড় প্রতিবন্ধক।

সুতরাং হুন্ডির বাজার পুরোপুরি বন্ধ করার উপায় নিয়ে সরকারের কাজ করা দরকার। সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ দুই ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একই সঙ্গে স্বল্প আয়ের প্রবাসীদের প্রণোদনা বাড়ানোও আবশ্যক।

প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে আয় পাঠাতে উৎসাহ প্রদানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জটিলতা কমাতে হবে। একই সঙ্গে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। এর জন্য প্রবাসীদের সঙ্গে শ্রম ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ বাড়ানো দরকার। সেবার মান উন্নত করতে হবে।

Loading...

প্রবাসীদের নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধার প্রতি নজর দেওয়া জরুরি। বিমানবন্দরে হয়রানিও বন্ধ করতে হবে। এর বাইরে বৈদেশিক শ্রমবাজারের বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর মূল কারণ চিহ্নিত করা ও সে অনুযায়ী সমাধানের পথে হাঁটা প্রয়োজন।

ব্যাপক জনশক্তি বিদেশে যাওয়ার পরও প্রত্যাশিত রেমিট্যান্স না পাওয়ার অন্যতম কারণ উচ্চমানের কাজ না পাওয়া। সে ক্ষেত্রে প্রবাসীদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই। দীর্ঘকাল ধরে উন্নয়ন সহযোগীরা প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিয়ে আসছেন।

বিভিন্ন সময়ে বাজেটেও এ ব্যাপারে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন খুব একটা দেখা যায়নি। উন্নয়ন সহযোগীদের তথ্যমতে, বাংলাদেশের সম্ভাব্য প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ৪৫-৫০ বিলিয়ন ডলার।

Loading...

সেই হিসাবে চলতি অর্থবছরে ২৮ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় এলেও প্রায় ৪০ শতাংশ অফিসিয়াল চ্যানেলের বাইরে থেকে যাচ্ছে। অনেক প্রবাসী আয়-ব্যয় হয় ব্যক্তি পর্যায়ে সোনার ব্যবসায় বা কর ফাঁকির কাজে।

তাই প্রবাসী আয় বাড়াতে হলে প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোয় উৎসাহিত করার পাশাপাশি সামগ্রিক করের হার যৌক্তিকীকরণসহ চোরাচালান ও বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হারেরও যৌক্তিকীকরণ প্রয়োজন।

Loading...

প্রবাসীদের আরও কীভাবে বিভিন্ন আয় বর্ধনকারী প্রকল্পে সম্পৃক্ত করা যায়, সেটি নিয়েও ভাবতে হবে।

মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

সমকাল

Loading...

Loading